বিডিআর বিদ্রোহের 2009

 ০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ১০টার মধ্যকার সময়ে ঢাকার তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে পিলখানা গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়। তীব্র গুলির শব্দে আশপাশের এলাকার মানুষ হতবিহবল অবস্থায় থাকলেও গোলাগুলি হচ্ছে কেন তা কেউ বুঝে উঠতে পারছিল না। শহরজুড়ে বেশ দ্রুত ঘটনা ছড়িয়ে যায় সবার মুখে মুখে। ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান ও সৈন্যদের আনাগোনা দেখে কারো বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়।

এক পর্যায়ে জানা গেল গোলাগুলি চলছে পিলখানার ভেতরে। সেখানে বিডিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করেছেন এমন খবর বেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পনের বছর আগে সেই বিডিআর বিদ্রোহে ৫০ জনের বেশি সেনা কর্মকর্তা নিহত হন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার ৫০ দিনের মধ্যেই তাদের সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ আসে। তখন সরকারের ভেতর কী চলছিল এবং সেই পরিস্থিতি তারা কিভাবে সামাল দিয়েছিল এই লেখায় সেদিকে ফিরে তাকানো হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর তৎপরতা পিলখানায় বিদ্রোহের খবর যখন ছড়িয়ে যায় তখন মন্ত্রীরা সচিবালয়ে গিয়ে তাদের দাপ্তরিক কাজ শুরু করেছন। পিলখানার ঘটনা তৎকালীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি করেছিল।

বিদ্রোহের খবর শোনার পর মন্ত্রীরা একে একে সচিবালয় থেকে বের হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনার দিকে রওনা হন।

মন্ত্রীরা সচিবালয়ে তাদের অফিসে যাবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বিডিআর বিদ্রোহের খবর শুনতে পান। এ সময় তারা নিজেদের নানা কর্মসূচি বাতিল করে দ্রুত মিন্টুরোডে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনায় যান। সেখানে কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেন।

তখন মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মূলত তিনটি জায়গা। প্রথমত; পিলখানায় কী ঘটছে? দ্বিতীয়ত; ক্যান্টনমেন্টে এর প্রতিক্রিয়া কী হয়েছে? তৃতীয়ত; প্রধানমন্ত্রী কী বলছেন?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বাস করতের মিন্টুরোডে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়। পিলখানার বিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে যাবার সাথে সাথে তিনি দফায় দফায় বৈঠক করেছেন।

প্রথম বৈঠকটি তিনি করেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সাথে। প্রায় দেড়-ঘণ্টা এই বৈঠক চলে। সে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি নিয়ে জাতীর উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।

বিদ্রোহ দমন করার নানা খুঁটিনাটি এবং এর রাজনৈতিক দিক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেন মন্ত্রীদের সাথে। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহ দমন করতে গেলে সেটির পরিণতি কী হতে পারে তা নিয়েও আলোচনা হয়।

শক্তি প্রয়োগের বিষয়টিকে সর্বশেষ উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় সরকারের তরফ থেকে। যার প্রতিফলন পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন সেখানে দেখা যায়।

এরপর প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেন সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানদের সাথে। সে বৈঠকে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়।

এরপর প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শরীক অন্যান্য দলের নেতাদের সাথে।

বিভিন্ন বৈঠকে যেসব আলোচনা হয় তার মধ্যে উঠে আসে যে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের হাতে ভারি অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। তাছাড়া পিলখানার অবস্থান ঢাকার অন্যতম জনবহুল এলাকায়।

বিদ্রোহীদের দমনের জন্য সেনাবাহিনী যদি শক্তি প্রয়োগ করতে যায় তাহলে বিডিআর সদস্যরাও সেটি প্রতিহত করবে। ফলে সংঘাত আরো বড় আকার ধারণ করতে পারে। এতে সাধারণ মানুষের অনেক প্রাণহানি হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছিল।


সেজন্য আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের ওপর জোর দেয়া হয় বৈঠকগুলোতে।

তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, তিন বাহিনী প্রধান বিকেলের দিকে আবারো প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বসেন।

বিডিআর বিদ্রোহের খবর শোনার পরপরই সেনা সদস্যরা পিলখানার বাইরে অবস্থান নেয়।

আলোচনার উদ্যোগ বেলা এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম পিলখানার দিকে যান।

তখন পিলখানার ভেতর থেকে গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এমন অবস্থায় তারা পিলখানার কাছাকাছি যেতে পারেননি। তারা কয়েক ঘন্টা বেশ খানিকটা দূরত্বে অবস্থান করেন।

হ্যান্ড মাইকে নিজেদের পরিচয় দিয়ে তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের পাঠিয়েছেন আলোচনার জন্য। গোলাগুলি বন্ধ করে বিদ্রোহী জওয়ানদের আলোচনায় বসার আহবান জানান জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম। এসব ঘটনা যখন ঘটছিল বিবিসির এই সংবাদদাতা তখন সেখানেই ছিলেন।

হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিয়ে তখন তারা দুটি মোবাইল টেলিফোন নম্বরও দেন এবং সে নম্বরগুলোতে যোগাযোগ করার আহবান জানান তারা। কিন্তু তাদের এসব কথায় গুরুত্ব দেয়নি বিদ্রোহী জওয়ানদের।

বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে অস্ত্রশস্ত্র বিদ্রোহ দমন করতে পারেন তা সম্পর্কে বিবিসির কথা আরও একটা প্রমাণ। দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে সংঘাতক সময়গুলোতে মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের সাথে তার দলকে সংযুক্ত রাখতে পারেন তা বলছেন একটি বিবিসি খবর।


No comments

Powered by Blogger.