গণভোটের নামে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা: সরকার ও তার মিত্রদের দ্বিমুখী অবস্থানে ক্ষুব্ধ বিএনপি



৩ নভেম্বর, ২০২৫: 

রাষ্ট্র সংস্কারের নামে প্রস্তাবিত গণভোটকে কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তার নতুন মিত্রদের ভূমিকা গভীর ষড়যন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি যখন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই গণভোটের মতো একটি অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাকে বিএনপি "জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ" এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার একটি সুস্পষ্ট "নীলনকশা" হিসেবে দেখছে।

নির্বাচনের পথে কাঁটা: সরকারের রহস্যজনক কৌশল

ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল ম্যান্ডেট ছিল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। কিন্তু সম্প্রতি "জুলাই চার্টার" বাস্তবায়নের নামে গণভোটের যে বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে, তার সময়সূচি নিয়ে সরকার ও তার সহযোগীদের রহস্যজনক অবস্থান পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বিএনপি শুরু থেকেই একটি যৌক্তিক ও সাশ্রয়ী প্রস্তাব দিয়ে আসছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা বারবার বলেছেন, "যদি গণভোট করতেই হয়, তবে তা নির্বাচনের দিনেই করা হোক। এতে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হবে না।"

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এই যৌক্তিক প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যা তাদের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।

সরকারের সহযোগী জামায়াত ও এনসিপির বিতর্কিত ভূমিকা

আশ্চর্যজনকভাবে, সরকারের এই অস্পষ্ট অবস্থানের সাথে সুর মিলিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং সম্প্রতি গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতো দলগুলো। যখন দেশের সব গণতান্ত্রিক শক্তি একটি দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে একাট্টা, তখন জামায়াত নির্বাচনের আগেই আলাদাভাবে গণভোট আয়োজনের দাবি তুলে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। অন্যদিকে, এনসিপির মতো অখ্যাত দলগুলোও এই বিতর্কে অংশ নিয়ে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্রকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে।

বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করছেন, এটি একটি অশুভ আঁতাত। তাদের মতে, যে দলগুলো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সক্ষমতা রাখে না, তারাই পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় থাকার পথ খুঁজছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যবহার করে নির্বাচনকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে।

"ঐকমত্য কমিশন": প্রহসনের নামান্তর?

"জাতীয় ঐকমত্য কমিশন"-এর কার্যক্রম এই ষড়যন্ত্রকে আরও স্পষ্ট করেছে। বিএনপি গণতন্ত্রের স্বার্থে সংলাপে অংশ নিয়ে তাদের সুস্পষ্ট মতামত ও ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) কমিশনে জমা দিয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাবে সেই মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে।

বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "এটি ছিল একটি সাজানো নাটক। আমাদের ডাকা হয়েছিল শুধু লোক দেখানোর জন্য। তাদের উদ্দেশ্য যদি সৎই থাকত, তবে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলের মতামতকে তারা এভাবে পদদলিত করতে পারত না। এর মাধ্যমেই প্রমাণ হয়, তারা একটি নিয়ন্ত্রিত ও পূর্বপরিকল্পিত পথে হাঁটছে।"

বিএনপির হুঁশিয়ারি

প্রায় ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এই নির্বাচনকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের শেষ সুযোগ হিসেবে দেখছে। দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, ছাত্র-জনতা যে লক্ষ্য নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল, সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার যেকোনো চেষ্টা করলে জনগণ তা প্রতিহত করবে।

সার্বিকভাবে, গণভোটের এই বিতর্ককে কেন্দ্র করে বিএনপি এবং তার সমর্থকরা মনে করছেন, এটি নিছকই একটি কালক্ষেপণের কৌশল। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠ থেকে দূরে রাখা এবং একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি করে নিজেদের অনৈতিক শাসনকে দীর্ঘায়িত করা, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না বলে দলটি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.