সৌদি আরবে কাফালা যুগের অবসান: চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে প্রবাসীদের জন্য উন্মুক্ত হলো নতুন দিগন্ত
ঐতিহাসিক সংস্কারে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বিদেশি কর্মী এখন থেকে নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়াই চাকরি পরিবর্তন ও দেশত্যাগ করতে পারবেন, যা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
রিয়াদ, সৌদি আরব:
সৌদি আরবে কয়েক দশক ধরে প্রচলিত এবং বহু বিতর্কিত ‘কাফালা’ বা কফিল (পৃষ্ঠপোষকতা) পদ্ধতির আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটেছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলা এই ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে এক ঐতিহাসিক সংস্কারের পথে হাঁটল মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। সরকারের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফলে সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বিদেশি শ্রমিকের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো, যাদের একটি বিশাল অংশ বাংলাদেশ, ভারত, ও পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর নাগরিক।
এখন থেকে প্রবাসী কর্মীদের কর্মসংস্থান আর কোনো নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তা বা ‘কফিলের’ ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। এর পরিবর্তে চালু হয়েছে একটি আধুনিক চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা, যা শ্রমিকদের স্বাধীনতা, অধিকার ও আইনি সুরক্ষাকে আগের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী করবে।
নতুন ব্যবস্থায় যা যা পরিবর্তন এলো
সৌদি আরবের মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ‘শ্রম সংস্কার উদ্যোগ’ (খধনড়ৎ জবভড়ৎস ওহরঃরধঃরাব) অনুযায়ী, প্রবাসী কর্মীরা এখন থেকে একাধিক মৌলিক অধিকার ভোগ করবেন:
চাকরি পরিবর্তনের স্বাধীনতা: কর্মীরা এখন থেকে তাদের বর্তমান নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়াই চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে বা নির্দিষ্ট শর্ত মেনে তারা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন।
স্বাধীনভাবে দেশত্যাগ ও প্রবেশ: কর্মীদের সৌদি আরব ত্যাগ করার জন্য এখন আর নিয়োগকর্তার কাছ থেকে এক্সিট বা রি-এন্ট্রি ভিসার অনুমতির প্রয়োজন হবে না। তারা সরকারি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি ভিসার আবেদন করতে পারবেন।
চুক্তিই হবে সম্পর্কের ভিত্তি: নিয়োগকর্তা ও কর্মীর সম্পর্ক একটি ডিজিটাল কর্মসংস্থান চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে, যেখানে বেতন, কাজের শর্ত এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।
উন্নত আইনি সুরক্ষা: নতুন ব্যবস্থায় কর্মীদের শোষণ বা হয়রানির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হবে, যা তাদের অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
‘ভিশন ২০৩০’ ও অর্থনৈতিক সংস্কার
এই শ্রম সংস্কারটি সৌদি আরবের महत्वाकांक्षी ‘ভিশন ২০৩০’ উদ্যোগের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মূল লক্ষ্য হলো দেশটির তেল-নির্ভর অর্থনীতিকে আধুনিক ও বৈচিত্র্যময় করা, বেসরকারি খাতের বিকাশ ঘটানো এবং বিদেশি বিনিয়োগ ও দক্ষ কর্মীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি করা।
সৌদি সরকার এই পদক্ষেপকে একটি ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
কেমন ছিল শোষণমূলক কফিল প্রথা?
১৯৫০-এর দশকে উপসাগরীয় অঞ্চলে গড়ে ওঠা ‘কাফালা’ ব্যবস্থার অধীনে অভিবাসী শ্রমিকদের আইনি মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে তাদের নিয়োগকর্তা বা ‘কফিল’-এর সঙ্গে যুক্ত থাকত। এর ফলে নিয়োগকর্তা শ্রমিকের পাসপোর্ট আটকে রাখা, কাজ পরিবর্তন করতে না দেওয়া, দেশ ত্যাগে বাধা দেওয়া এবং নানাভাবে শোষণ করার সুযোগ পেতেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রায়শই এই প্রথাকে ‘আধুনিক দাসপ্রথা’ হিসেবে আখ্যায়িত করত।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও এর সঠিক ও কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে। তাদের মতে, আইনের পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, এর সুফল যেন প্রান্তিক কর্মীদের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ। তবে সব মিলিয়ে, এই পরিবর্তন সৌদি আরবে কর্মরত লক্ষ লক্ষ প্রবাসী কর্মীর জীবনে মর্যাদা ও সুরক্ষার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

No comments